২৬ বছর বয়সে বিশ্বের তরুণ বিলিয়নিয়ার দের মাঝে জায়গা করে নিয়েছেন। একচুয়ালি ২৬ না এর ও আগেই।
আমরা যে বয়সে কিছু করবো ভাবিনা, যে বয়সে ক্যারিয়ার বলতে ভাবি যে পড়াশুনা, চাকরীর জন্য প্রিপারেশন, যে বয়সে আমাদের পকেট এ টাকা থাকেনা কিংবা থাকলে ও টান টান অবস্থা এবং অবশ্যই বাবার দেয়া টাকা, ঠিক তার ও আগেই রিতেশ হয়েছেন বিশ্বের তরুণ বিলিয়নিয়ারদের একজন।
কিভাবে?? বাবার অনেক টাকা ছিলো নাতিনি আমেরিকা বা ক্যালিফোর্নিয়া বা সুইডেন থেকে ও নন যে তাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি।। তিনি এমন এক জায়গা থেকে এসেছেন যেখানের মানুষের মাথাপিছু আয় দিনে ১০ ডলার এর ও কম।। ইন্ডিয়ার উড়িষ্যার রায়াগাদা তে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। যেখানে তার বাবার ছিল একটা দোকান সেখানে বাবার টাকায় বিজনেস শুরু করার মত টাকা কখনোই তার ছিলোনা।
যখন তার আট বছর, যখন বাচ্চারা খেলাধুলায় মত্ত থাকে তখন থেকেই তিনি কোডিং নিয়ে কাজ করতেন। সেই সময়কার সেই খেলা, কাজ ই তার মনে অরভাব ফেলে, ভাবেন সফটওয়্যার রিলেটেড পড়াশুনা করবেন। কিন্তু হয়ে উঠেনা। পড়ালেখা তাকে কখনোই টানতোনা। সব সময় পড়ায় ফাঁকি দিতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।
২০০৬ সালে মোবাইল সীম এর ব্যবসা শুরু করেন, সেই সময় টায় সীম ব্যবসার ছিলো খুব ই দাপট।। সেই ১৩ বছর বয়স থেকে এভাবেই তার বিজনেসে হাতে খড়ি।
কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুড়তেন, বিভিন্ন স্টার্টআপ কোম্পানি সম্পর্কে জানতেন, ইন্টার্ন করতেন। নেশা পেশা সব ছিলো উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে৷ একবার ভেবেছিলেন স্যট এক্সাম দিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমাবে৷ পড়াশুনার উদ্দেশ্যে । কিন্তু হয়না। এরপর ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন এর ইন্ডিয়া ক্যামপাস এ ভর্তি ও হন কিন্তু ৩ দিনের মাথায় বুঝেন সে এসব সম্ভব না৷ রেজাল্ট খারাপ হবে বাবা মা কষ্ট পাবে, যেহেতু তার এদিকে মন নাই তাই সে ও কষ্ট পাবে৷ এর থেকে ভালো একজন কষ্ট পাক৷ বাবা মা যেহেতু এমনিতে ও কষ্ট পাবে তাই নিজে ভালো থাকারচেষ্টায় নিজের মনের কাজ বেছে নিতে পড়ালেখা বাদ দেন।
এসময় তার উদ্দেশ্য একটাই উদ্যোক্তা হবেন। কিন্তু এ পথ তো অনেক কঠিন, আর পকেটে নাই টাকা নাই কোন ইউনিক আইডিয়া ও।
রিতেশ এর ঘুড়াঘুড়ির শখ ছিলো। মাঝে মাঝেই ট্রেন এ চেপে বসতেন যেহেতু ট্রেন সবথেকে সস্তা, বিভিন্ন জায়গায় ঘুড়তেন কিন্তু একটা জায়গা তাকে খুব ই পীড়া দিতো তা হলো থাকার জায়গা, ভালো সার্ভিস এবং বাজেট এর সামঞ্জস্যতা। এই ব্যাপার গুলোকে মাথায় রেখে ভাবেন যে এই আইডিয়া নিয়েই এগুবেন। কিন্তু তার আগে জানা খুব বেশি জরুরী৷ তাই প্রাকটিক্যাল অভিজ্ঞতার জন্য ঘুড়ে বেড়াতে থাকেন বিভিন্ন শহরে, কথা বলেন হোটেল মালিকদের সাথে, কথা বলেন ভ্রমণপিপাসু মানুষদের সাথে। এর পর ২০১২ তে প্রতিষ্ঠা করেন ওরাভল স্টেইস। যা ইন্টারনেট ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান এখানে কম ও মধ্যম বাজেটের হোটেল বুকিং দেয়া যেত, নিজের কিছুইনা। বেশ ভালোই চলছিলো, কিছুদিন এর মাঝেই নার্সারি থেকে ৩০ লাখ রুপির ফান্ড পেয়ে যান তিনি। এই সময়ে তিনি জানেন থিয়েল ফেলোশীপ এর কথা। পে-প্যাল এর কো-ফাউন্ডার এবং ফেসবুক এর শুরুর দিকের ইনভেস্টর পিটার থিয়েল এ ফেলোশীপ বিশ্বব্যাপী প্রদান করেন৷ যেখানে এপ্লাইকারো অবশ্যই ২০ বছরের নিচে হবে, ড্রপ আউট হবে এবং তার কোন ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া থাকবে। এখানে এপ্লাই করেন, এবং এর পরপর ই তিনি সিলেক্টেড হন এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এই ফেলোশীপ এর। পেয়ে যান প্রায় এক লাখ এর ডলার ও কয়েকটি দেশে ভ্রমণের সুযোগ।
এরপরে ও তার কোমপানি গতি হাড়িয়ে ফেলে। টিকে থাকতে পারেনা। গুটিয়ে নিতে হয় বিজনেস কিন্তু থেমে থাকেনা রিতেশ। দিনরাত একটাই ভাবনা কি করে আবার শুরু করা যায়৷ এক সময় তার পাশেই একটা হোটেল কে দিনের পর দিন খালি যেতে দেখেন, হোটেল এর মালিক ও হাল ছেড়ে দিতে থাকে, এরপর তিনি আগের বিজনেস এর আইডিয়ার সাথে নতুন কিছু যোগ করে আবারো ২০১৩ তে। শুরু করেন সেই খালি যাওয়া হোটেল কে নিয়েই নিয়ে নেন লাইফ এর সবথেকে বড় রিস্ক। নাম চেঞ্জ করে দেন OYO Rooms ( On Your Own). এবারের আইডিয়া হয় মূলত মধ্যবিত্ত দের জন্য যারা কিনা বাজেট এর জন্যই ট্যুর ক্যান্সেল করে। মিনিমাম বাজেট এ কি করে সব সুবিধা দেয়া যায় এবং তা যদি একজন আগে থেকেই রুম, খাবার, সুবিধা সব জেনে আসে তাহলে ভোগান্তিও কম হয়। এ সময় ভারতে এমন কিছুই ছিলোনা।
এরপর নিজেই হোটেল গুছানোর কাজ শুরু করেন। হোটেল ক্লিন, গুছানো, বিছানা, দেয়াল সবকিছু নিজের মনের মত সাজিয়ে, সুবিধা, বাজেট সহ ছবি আপলোড করতে থাকেন ওয়েবসাইট এ। কিছুদিনের মধ্যেই সেই খালি হোটেল ভরে যেতে থাকে।
২০১৪ সালে OYO তে ৪ কোটির বেশি রূপি ইনভেস্ট করে লাইটস্পীড ইনভেস্টর, এরপর অনেক ইনভেস্টর পেয়েছেন এবং যতবার যত ইনভেস্টর পেয়েছেন ততবার ই তিনি কোম্পানি তে নতুন কিছু না কিছু সুবিধা যোগ করেছেন। রিতেশ এর বিশ্বাস ছিলো যদি একটা কে দাড় করানো যায় এমন ১০০ টা দাড় করানো যাবে। শুরুটা যদি শক্ত ভাবে দাড় হয়ে যায় এর পরের কাজ অনেক বেশি সহজ হয়।
এরপর সেই হোটেল এ এত কাজ বাড়ে যে তার ৫০ জন মানুষ কে লাগাতে হয়। যা ২১ বছরের সময় হয়। ২২ বছর বয়সে তার ৫০০ টি হোটেল থাকে এবং ২৪ বছর বয়সে সে বিলিয়ন ডলার কোম্পানি তে নিজের নাম লেখায়। ২৬ বছর বয়সে তা বেরে দাড়ায় ৪৩০০০ হোটেল এবং তার এই৷ OYO Rooms হয়ে উঠে বিশ্বের ২য় বড় হোটেল চেইন এবং সে তার কোম্পানির মাধ্যমে ৩৫০০০০ মানুষের সেবা দিয়ে আসছে। নিজের কোম্পানির ই আছে প্রায় ১৭০০০ এর ও বেশি শ্রমিক।
এতটা সহজ ছিলোনা তার জার্নি।।। প্রচুর প্রচুর পরিশ্রম করে এসেছেন। ইভেন শুরুর দিকে হোটেল এর সব কাজ নিজে করতেন, ওয়েটার থেকে শুরু করে যেকোন সেবা। এর কারণে অনেক সময় তাকে বখশিস ও দিয়েছে অনেকেই কেননা নিজেকে মালিক হিসেবে দাড় করায়নি কখনো, সব সময় কাজ কে ভালোবেসে কাজ করে গেছে। দিনরাত কাজ করেছেন৷ ইন্টারনেট, মেইল, অনলাইন, অফলাইন সব জায়গায় শ্রম দিয়েছেন সবার ভেতরের সমস্যা জানার চেষ্টা করেছেন এবং তা সলভ করেছেন। । নিজের হোটেল এর র্যাংকিং 4* এর উপর পেতে সব সময় শ্রম দিয়ে গেছেন তিনি। এর বিনিময়ে রাস্তায় বিলবোর্ড এ যখন নিজের কোম্পানির নাম দেখতে পারতেন সেসব কে ই শান্তি হিসেবে নিয়েছিলেন।
জীবনে ডেসটিনিকে খুব বিশ্বাস করেন এবং সবথেকে বেশি বিশ্বাস করতেন কাজ কে। ৫ বছর পর তার কোমপানি নাম পেয়েছে। বিলিয়নিয়র হয়েছে। এবং পরবর্তী বিলিয়নিয়র হয়েছে কিন্তু পরের এক বছরেই৷। মানে ৬ বছরে তার কোম্পানি পৌছেছে আড়াই বিলিয়ন ডলার এর কাছাকাছি।। হ্যা, আগে কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় ধরা খেয়েছে এর পর।
একেবারেই সিম্পল ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা রিতেশ, পড়াশুনা ছেড়ে দেয়ার পর কতটা কঠিন হতে পারে সেই লাইফ? ইভেন কত লোকে বলেছে এসব ছেড়ে আবারো ইউনিভার্সিটি জয়েন করতে, পাগল বলেছে লোকে তাকে। নিজেও নিজেকে পাগল বলেছে তবে কাজ পাগল ৷
৬ বছর সময়, শ্রম ইনভেস্ট করেছে একদিকে৷ বিনিময়ে ৮০ টির বেশি দেশের ৮০০ টি র বেশি শহরে তার হোটেল দিচ্ছে বেস্ট সার্ভিস।৷ তার OYO apps ডাউনলোড হয়েছে 5M এর বেশি বার। গুগল প্লে এপ্স এর ট্রাভেলার্স এপ্স এর মাঝে সেরা ৩ টার একটি তার এই এপ্স।
আর হ্যা, সব সময় একাডেমিক পড়াশুনা তাকে না টানলেও Entrepreneurs, Start ups, Business, AIR Bnb… এগুলোতে ইন্টারেস্ট খুজে পেতেন। সব সময় আপডেট থাকতেন, প্রচুর পড়তেন, জানতেন৷ জানার চেষ্টায় দ্বারে দ্বারে ঘুড়েছেন পর্যন্ত।
এই বয়সে রিতেশ আমাদের জন্য অনেক বড় শিক্ষা দেয়৷ লেগে থাকার শিক্ষা দেয়, পরিশ্রম করার শিক্ষা দেয়।। এত বছর লেগে থেকেছে, কত ups & down এসেছে কিন্তু উঠে দাড়িয়েছে, শর্টকাট এর চিন্তা করেনি একদম ই। নিজের ফোকাসিং থেকে সরেনি এক চুল৷ যার বিনিময়ে ২০২০ সালে পেয়েছেন Worlds, Youngest Billionaires Award. এছাড়াও পেয়েছেন টি আই ই ল্যুমিস বিজনেস এক্সিলেন্স এওয়ার্ড, ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলমার্ট এওয়ার্ড সহ বেশ কিছু পুরস্কার।
এখানে একটা ব্যাপার খুব লক্ষণীয় এ প্রথমে শুরু টা শুরু হয়ে গেলে পরের ধাপ গুলো অনেক সহজ হয়। আসলেই শুরু করাটা অনেক কঠিন। আরিফা মডেল শুরু হয়েছেন। আরিফা আপু শুরু করেছেন জন্য এখন তা আমাদের জন্য সহজ হয়ে উঠেছে। দিন যত যাবে একসেপ্ট করবে মানুষ বেশি, ছড়িয়ে পরবে আইডিয়া।৷ লেগে থাকার মানসিকতা রাখলে এক সময় ভালো কিছু হবে।
সফলতার কোন শর্টকাট নেই। শর্টকাট এ ১% লোক হয়তো সফল হতে পারে কিন্তু ৯৯% লোকের বেলাতেই প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় এবং অনেক দিন ধৈর্য নিয়ে লেগে থেকে সফল হতে হয়৷ রিতেশ প্রমাণ করেছে বয়স বা আর্থিক অবস্থা না এক মনে এক দিকে লম্বা সময় লেগে থাকলে, শ্রম দিলে ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব।
লেখক : স্বত্বাধিকারী, ইপ্পি শপিং