প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত

আন্তর্জাতিক

পৃথিবীতে যত খ্যাতিমান কবি – সাহিত্যিক রয়েছেন তাদের জীবনী পড়লে দেখা যায় শিল্প-সাহিত্যের দেশ ফ্রান্স, তাদের জীবন ও স্বপ্নের একটি অংশ। 

রম্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় বলতে গেলে স্বপ্ন ও পরিকল্পনা দিয়ে সাজানো প্যারিস শহর আর বই জিনিসটার প্রকৃত সম্মান দিতে জানে ফ্রান্স।সৈয়দ মুজতবা আলী প্যারিস থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন। আদিকাল থেকে ফরাসিরা বিশ্বের সকল কবি-সাহিত্যিকের সম্মান জানিয়েছেন আপন মর্যাদায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে প্যারিসে আসলেন। 

জার্মানি নাগরিক, ফরাসি ব্যাংকার আলবার্ট আইনস্টাইন কান এর নামের সাথে আমরা সবাই পরিচিত তিনি ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। (১৮৬০–১৯৪০) ‘আর্কাইভস্ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকে ক্যামেরায় বন্দী করা। তিনি ফ্রান্সের Boulogne-Billancourt-এ একটি বাগান তৈরি করে সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধান প্রধান স্মারক চিহ্ন আর গাছপালা। একই সঙ্গে তৈরি করেন একটি স্টুডিও।
১৯০৯ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আলবার্ট কান ২৩ জন নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের প্রায় ৪০০০ অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, আর্টিস্টকে তাঁর বাগানে আমন্ত্রণ করেন এবং তাঁর নিযুক্ত এই ফটোগ্রাফার এবং সিনেমাটোগ্রাফাররা এই বিশ্বখ্যাত অতিথিদের নিয়ে ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্রে ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। 

আমন্ত্রণ জানানো হয় বাংলা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ১৯২১ এবং ১৯৩০ সালে দুই বার ফ্রান্সে আগমন করেন এবং কর্মসূচিতে যোগ দেন।

সেই সময়ে রঙিন ফটোগ্রাফি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল। বিশ্বের ৫০টি দেশের মানুষ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও আচার অনুষ্ঠান, গাছপালা, ল্যান্ডস্কেপ প্রকল্পের অন্তর্গত ছিল। 

১৯৮৬ সালে বাগানে একটি মিউজিয়াম করা হয় এবং তাতে ছবি ও ভিডিও’র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে পর্যটকদের জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভিডিওটি মিউজিয়ামের ওয়েবসাইটে আছে। এখানে শেষ নয় ইউরোপের সর্ববৃহৎ ন্যাচারাল পার্ক parc departmental des chatelaines (পার্ক ডিপারমেন্টাল ডে সনতে)ইউরোপের মধ্যে জীব বিজ্ঞান বিষয়ক পি এইচ ডি করতে হলে এই পার্কে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে আসতে হয়। কোন পর্যটক এই পার্কটি দেখতে হলে মেট্রোরেল এর সাহায্যে নিতে হয়। পার্কের একপাশে ঐ সময়কার তোলা ছবি গুলো সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রেখেছেন কর্তৃপক্ষ। গৌরবের সাথে দাঁড়িয়ে আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি, যা একজন বাঙালি হিসেবে দেখে গৌরব করার মত। 
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আদিকার দেশ ফ্রান্সে এলেন যেভাবে। 

বাংলা সাহিত্যে প্রাণপুরুষ প্রথম সনেট ও নব জাগরণের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার জীবন নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণার বাতিঘর তাই তার জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই। তিনি ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়।১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি মিশন রো-তে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। “মাইকেল” নামকরণ করেন। পরিচিত পান “মাইকেল মধুসূদন দত্ত” নামে। 

রাজনারায়ণ দত্ত তার বিধর্মী পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। পিতা তাকে পরিত্যাগ করলেও পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করেন এবং চার বছর পর তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। বিশপস কলেজে কয়েকজন মাদ্রাজি ছাত্রের সঙ্গে মধুসূদনের বন্ধুত্ব হয়। চেন্নাইয়ে কোন চাকরি না পেয়ে আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতসারে নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে মাদ্রাজ পৌঁছেন। এক সময় জানতে পারেন তার পিতা – মাতার মৃত্যু হয়েছে এবং তিনি দেশে গিয়ে আবারও বৈষম্যের শিকার হন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর পরামর্শে কবি ইংল্যান্ডে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতে যান, কিন্তু সেখানের আবহাওয়া ও বর্ণবাদিতার কারণে বেশি দিন ইংল্যান্ডে থাকেন নাই। তিনি ১৮৬০ সালে ধর্মনিরপক্ষ, বিশ্বমানবতার দেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে এসে জীবনের দীর্ঘ ২ বছর সময় পার করেন । তিনি ফরাসি ভাষা সহ ১২টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। 

কবির জীবনে আর্থিক, মানসিক, প্রতিভা বিকশিত করার প্রেরণা জুগিয়ে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ জন্য ১৮৬৪ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর লেখা বই ফ্রান্সের একটি বইয়ের দোকানে সাজানো রয়েছে দেখে খুব আশ্চর্য এবং অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।