সম্ভাবনাময় টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারস

উদ্যোক্তা পপি সরকার

রাণীর মত মাথায় মুকুট পরে বসে থাকে, টক টক মিষ্টি মিষ্টি একটা ফল আনারস। চেহারার এত সৌন্দর্য, রূপ এবং গুনের জন্য কাব্যরসিক রা একে স্বর্ণকুমারী ও বলে থাকেন। সেই আনারস বলতে আমাদের দেশে প্রথম যে নাম টা মনে আসে তা হলো আমাদের টাংগাইল জেলার মধুপুর উপজেলা। মধুপুর এর আনারস মানে ই মুখে লেগে থাকা এক টুকরো স্বাদ৷

আনারস এর উৎপত্তিস্থল ব্রাজিল কে ধরা হয় এবং তা আমাদের দেশে আসে আনুমানিক ১৫৪৮ সালের দিকে। পুরো দেশের মাঝে সবথেকে বেশি আনারস হয় মধুপুরে।

পুরো মধুপুর জুড়ে ই বিভিন্ন গ্রামে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চাষ হয় আনারস এর তবে এর মাঝে ও অরুণখোলা, ষোলাকুঁড়ি, আউশনারা ইউনিয়নে সবথেকে বেশি আনারস এর চাষা হয়। সারাবছর জুড়ে ই অল্প স্বল্প আনারস এর দেখা মিললে ও আষাঢ় এর মাঝামাঝি থেকে শ্রাবণ মাস এর শেষ পর্যন্ত প্রচুর আনারস এর ফলন হয় এ এলাকায়।

মধুপুর অঞ্চলের উঁচু জমি, দো-আশ ও বেলে মাটি আনারস চাষের জন্য এত্ত উপযোগী যে বহু পরিমাণ আনারস প্রতি বছর উৎপাদন হয়৷ টাংগাইল এ আনুমানিক মোট ২২৫০০ একর জমির মাঝে শুধু মধুপুর এ ই ১৮৭৫০ একর জমিতে চাষ হয় আনারস এর।

আনারসের রাজধানী বলা হয় মধুপুরের জলছত্র বাজার কে। এছাড়া ও গারো বাজার, মধুপুর বাজার ও ২৫ মাইল বাজারে আনারসের বেচাকেনা হলে ও জলছত্র বাজারে রাস্তার দুপাশ ধরে লম্বা জায়গা জুড়ে মেলার মত বসে আনারসের হাট। যেখানে দূর দূরান্ত থেকে ক্রেতারা ভীড় জমায় পাইকারি কিংবা খুচরা দরে আনারস কিনতে। সাইকেল, ঘোড়া গাড়ি কিংবা ভ্যান বা পিক আপ ভর্তি করে কৃষকরা আনারস নিয়ে ধীরে ধীরে পাড়ি জমাতে থাকে মধুপুর এর জলছত্র বাজারে।

ভিটামিন এ বি সি তে সহ বিভিন্ন পুষ্টিগুণে ভরপুর আনারস এবং মৌসুমি ফল হিসেবে অনেক বেশি চাহিদা আছে আনারস এর। আনারস এর স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক বেশি। যেমনঃ

◑আমরা কিন্ত কম বেশি সবাই জানি খুশখুশে জ্বর এ আনারস খুব উপকারী। যার কারণে অনেক পরিবারেই এখন ও জ্বর এর সময় খাদ্য হিসেবে আনারস এর খোজ করা হয়। আমার মা কে দেখি জ্বরে আনারস খেতে।

◑আনারস এর জ্যুস যেকোন রকম ক্ষত সারাতে খুব কার্যকর। আনারস হজম বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, পেশীর ব্যাথা কমায়।

◑ক্যান্সারের সম্ভাবনা অনেক কমে যায় প্রতিদিন আনারস খেলে। অদূর ভবিষ্যতে আনারস থেকে ক্যান্সার এর ওষুধ তৈরির পরিকল্পনা আছে বলে জানা যায়।

◑হার্ট ভালো রাখতে আনারস বড় ভূমিকা পালন করে।

◑চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে৷

◑দ্রুত ওজন কমাতে সহায়তা করে।

◑এছাড়া কচি আনারস এবং তার পাতার রস কৃমি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে দেয়।

◑দাঁত ও মাড়ির যে কোন সমস্যা সমাধানে আনারস খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নানাবিধ উপকারীতায় ভরপুর মধুপুর এর ছোট্ট, মিষ্টি আনারসের গন্ধে মৌ মৌ করতো আগে পুরো বাজার, সারা মধুপুর। কিন্তু সেই গন্ধ এখন পাওয়া যায়না শুধুমাত্র হরমোন ব্যবহার এর কারণে। এলাকার চাষীরা এই হরমোন কে গর্ভবতী হরমোন বলে থাকে কেননা এটি ব্যবহার এ আনারসে দ্রুত ফলন আসে এবং একসাথে সব আনারস পাকে। যার কারণে একসাথে বাজার জাত করতে চাষীদের সুবিধা হয়। ফল বোর হয়, দেখতে সুন্দর হয় জন্য ক্রেতা আকর্ষণ বাড়ে। তবে হ্যা খেতে স্বাদ কমে গেছে জন্য মধুপুর এর আনারস এর খ্যাতি ও কমে যেতে শুরু করে।

একটা সময় ছিলো যখন স্বাভাবিক ভাবে পাকা আনারসে মৌমাছি বসতো, শেয়ালের যন্ত্রনায় আনারস রক্ষা করতে কড়া নজড়দারি রাখতে হতো। কিন্ত হরমোন ব্যবহার এর ফলে আনারসের তেমন গন্ধ হয়না, মৌমাছি ও বসেনা এবং শেয়ালের উৎপাত ও নেই।

আসলে সমস্যা হচ্ছে আনারস গাছে ফুল আসতে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৬ মাস। আনারস পেকে বাজারজাত করতে সময় লাগে ২১ থেকে ২২ মাস। এত লম্বা সময় ধরে আনারস চাষের ফলে আনারসের জমিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আবার ন্যাচারালি আনারস একসাথে পাকে না, যার কারণে বাজারজাত সমস্যা হয়, একটু করে আনারস বাজারে নিলে দামের সাথে পুষিয়ে উঠা যায়না, আবার বেশি আনারস নেয়ার জন্য অপেক্ষা করলে অনেক সময় আনারসে পচন ধরে, পঁচে যায় অনেল আনারস, ক্ষতি হয় কৃষকের। এইসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অনেক চাষীরা এতে বিভিন্ন হরমোন ব্যবহার করে এই হরমোন ব্যবহার এর ক্ষেত্রে যেখানে ৬০ পাতা নাহলে আনারস ফল দেয়না সেখানে ২৮ পাতা হলে ই ফুল দেয় এবং একসাথে ফল হয়। এদিকে ফল পাকার জন্য হরমোন ব্যবহার করলে সব একসাথে পাকে, হরমোন ব্যবহার এর ৪-৫ দিনেই আনারস পাকতে শুরু করে।

জলডুগি নামে আনারসের যে জাত আছে তা দেখতে ছোট হলে ও খেতে সবথেকে মজা এবং ফলন অপেক্ষাকৃত দ্রুত হয়। দ্রুত হলে মৌসুমের আগে ফল তুলতে পারলে দাম টা ও একটু ভালো পাওয়া যায়, যার কারণে এখন অনেক কৃষক জলডুগি র দিকে ঝুকে কিন্তু ক্রেতা রা বড় আনারস কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে বেশি তাই কৃষকেরা জলডুগি করে এবং পাশাপাশি হরমোন ব্যবহার করে বড় আনারস এর জন্য। এই ব্যাপার গুলো থেকে তখন ই বের হওয়া যাবে যখন অনেক বেশি প্রচারের মাধ্যনে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যাবে।

সারাদেশ থেকে মধুপুর এর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো জন্য সারাদেশে সহজে ই তা ট্রান্সপোর্ট সম্ভব হয়। এই সম্ভাবনাময় পণ্যকে ই-কমার্স এর আওতায় নিতে পারলে যুবসমাজের মাঝে ও অনেক কর্মসংস্থান হতে পারে। ক্ষেত্রটা আসলে ই পরিপূর্ণ। আমরা আম, লিচু এসব যদি ই-কমার্স এর অন্তর্ভুক্ত করে এত আশানুরূপ ফল পেতে পারি তাহলে প্রচুর ফলনশীল আনারস কে ঘীরে ভবিষ্যৎ অবশ্যই উজ্জ্বল।

আনারস নিয়ে ই-কমার্স সেক্টর এ কাজ করলে বহুবীধ সুযোগ আছে। কারণ আনারসের পাশাপাশি এই এলাকায় আনারসের জমিতে ই, আনারসের ফাঁকে ফাঁকে চাষ করা হয় কলা, আদা, হলুদ আরো বিভিন্ন কিছু যাতে উদ্যোগ গ্রহনকারী কে ও শুধুমাত্র আনারসের জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা এবং একসাথে না পাকার কারণে এই যে আনারসে হরমোন দিয়ে জনপ্রিয়তা হারানো, তা ও ফিরে আসবে৷

শুধুমাত্র আনারস না, ই-কমার্স এর আওতাধীনে আনা যেতে পারে আনারস এর জেলী কে। মধুপুর এ গারো দের মাঝে অনেক কে ই আনারস এর জেলী তৈরি করতে দেখা যায়। অবশ্য শুধু গারো রা না হোমমেইড উপায়ে যে কেউ এই জেলী তৈরি করতে পারে।

এছাড়া ও আনারস এর পাতা থেকে তৈরি হয় মোম ও সুতা। প্রয়োজন শুধু এসব কে সকলের সামনে তুলে ধরে উদ্যোগ গ্রহন করা। আনারস মানে শুধু আনারস এ সীমাবদ্ধ না, যে কোন উদ্যোক্তার জন্য অনেক গুলো পণ্য নিয়ে কাজ করার সুযোগ মিলবে এতে।

ইতিমধ্যে ই সরকারি প্রতিষ্ঠান হটেক্স ফাউন্ডেশন এর সহায়তায় মধুপুর এর আনারস দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে ইউরোপ এ ও পাড়ি জমিয়েছে। সেক্ষেত্রে কৃষকদের আশ্বাস ছিলো অবশ্যই হরমোন ছাড়া আনারস উৎপাদন এর এবং করেছে ও তাই। অনেক চাষী রা এখন ও কোন প্রকার হরমোন ব্যবহার করেনা। জৈবসার ই তাদের ভরসা। এবং এই হটেক্স ফাউন্ডেশন এর তত্ত্বাবধানে তারা আনারস পাকার জন্য হরমোনের পরীবর্তে করবে গ্যাসীয় পদ্ধতির ব্যবহার৷ এরকম ই পরিকল্পনা চলছে।

অনেক বেশি ব্যবসাসফল আমাদের মধুপুর এর আনারস কিন্তু এরপরে ও ই-কমার্স এর ছোয়া থেকে অনেক দূরে। অনেক কারণে পিছিয়ে আছে এ এলাকার কৃষক সমাজ। বেশির ভাগ ই তাদের অজ্ঞতার কারণ। চ্যালেঞ্জ টা এখানে ই। চ্যালেঞ্জ নিতে কৃষকদের পাশে দাড়াতে হবে যুবসমাজের, নিতে হবে বহুবীধ উদ্যোগ। নিজেদের উদ্যোগ এর স্বার্থে ই কৃষক দের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং ই-কমার্স এর মাধ্যমে একেবারে অর্গানিক আনারস পৌছে দেয়া যাবে জনগনের কাছে।

যেহেতু অনেক বড় সেক্টর, সম্ভাবনা ও অনেক বড় এবং এগিয়ে আসতে হবে অনেকের ই। নিজেদের জায়গা থেকে উদ্যোগ গ্রহন ই পারে এমন একটা সম্ভাবনাময় সেক্টর কে সকলের সামনে তুলে ধরতে, পৌছে দিতে একেবারে ক্রেতাদের দ্বারপ্রান্তে। দ্রুত প্রচার এবং প্রসারে ই-কমার্স সবথেকে উপযোগী মাধ্যম কোন সন্দেহ নেই।

লেখক : স্বত্বাধিকারী, ইপ্পি শপিং