যেভাবে সূচনা হয়েছিল কোরবানির

ইসলাম

কোরবান আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ কাছে যাওয়া বা নৈকট্য অর্জন করা। ইসলামি ফিকহের পরিভাষায় কোরবানি হলো জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম ১০ জিলহজ সকাল থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদ অর্থাৎ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর যেকোনো একটির মূল্যের সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা ব্যবসার পণ্যের মালিক থাকেন- তার জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব হবে।

আদম আ. থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে মহান আল্লাহ তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছেন। (তাফসিরে নাসাফী ৩/৭৯)

আদম আ. থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে মহান আল্লাহ তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছেন। (তাফসিরে নাসাফী ৩/৭৯)

প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির বিধান

পৃথিবীর শুরু থেকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর উম্মতের উপর কোরবানির বিধান ছিল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কোরবানির বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা উক্ত পশু জবাই করার সময় মহান আল্লাহর নাম স্মরণ করে এ জন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের জন্য রিজিক নির্ধারণ করেছেন।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৪)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী রহ. বলেন, ‘আদম আ. থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে মহান আল্লাহ তার নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছেন। (তাফসিরে নাসাফী ৩/৭৯)

আদম (আ.)-এর সময়ে কোরবানি

পৃথিবীর শুরুর কথা। মাত্র পৃথিবীতে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে। জান্নাত থেকে হযরত আদম ও হাওয়া (আ.) মাটির এ পৃথিবীতে এসেছেন সে সময়ের কথা। বংশবিস্তার আরম্ভ হচ্ছে তাদের সন্তানদের মাধ্যমে। প্রতি গর্ভ থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত।


তখন একশ্রেণির ভাই-বোন ছাড়া হযরত আদম (আ.)-এর আর কোনো সন্তান ছিল না। অথচ ভাই-বোন বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। আপন ভাই-বোন বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম। মহা অন্যায়। তাই মহান আল্লাহ প্রয়োজনের তাগিদে হযরত আদম (আ.)-এর শরিয়তে বিশেষভাবে নির্দেশ জারি করেন, একই গর্ভ থেকে যে যমজ ছেলে ও মেয়ে জন্মগ্রহণ করবে তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন গণ্য হবে।

তাই তাদের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারীর জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী সহোদর গণ্য হবে না। তাই তাদের পরস্পর বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে।

ঘটনাক্রমে হযরত আদম (আ.)-এর ছেলে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোন ‘আকলিমা’ ছিল অনিন্দ সুন্দরী। আর তার অপর ছেলে হাবিলের সহজাত বোন ‘লিওজা’ ছিল কুশ্রী, কদাকার। বিয়ের সময় হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত বোন কাবিলের ভাগে পড়ল। আর কাবিলের সহজাত বোন হাবিলের ভাগে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু বনে গেল। সে জেদ ধরে বলর, ‘আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। আমি হাবিলের সঙ্গে ‘আকলিমা’ কে বিয়ে হতে দেব না।’

হযরত আদম (আ.) শরিয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন। অত:পর তিনি হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বলেন, 

তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কোরবানি পেশ করো। যার কোরবানি কবুল হবে, সে-ই আকলিমাকে বিয়ে করবে।’ হযরত আদম (আ.)-এর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, যে সত্য পথে আছে, তার কোরবানিই কবুল হবে। সেকালে কোরবানি কবুল হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কোরবানিকে পুড়িয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, حَتّٰی یَاۡتِیَنَا بِقُرۡبَانٍ تَاۡکُلُهُ النَّارُ ‘ওই কোরবানি, যাকে আগুন গ্রাস করে নেবে। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৩)

আর যে কোরবানিকে আগুন জ্বালিয়ে দিত না, সেটাকে প্রত্যাখ্যাত গণ্য করা হতো। কোরবানির এ পদ্ধতি প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ পর্যন্ত সব যুগেই বলবৎ ছিল।

হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু পালন করতো। সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কোরবানি করল। আর কাবিল করতো কৃষি কাজ। সে কিছু শস্য-গম ইত্যাদি কোরবানির জন্য উপস্থিত করল। অতঃপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কোরবানিটি ভস্মিভূত করে দিল এবং কাবিলের কোরবানি যেমন ছিল তেমনই পড়ে রইল। 

এ অকৃতকার্যতায় কাবিলের দু:খ ও ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারলো না এবং প্রকাশ্যে তার ভাইকে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। হাবিল তখন ক্ষোভের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করল। যা সুরা আল মায়েদার ২৮ থেকে ৩০ নম্বর আয়াতের বঙ্গানুবাদে বর্ণিত হয়েছে। ‘(হাবিল বলল) ‘তুমি যদি আজ আমাকে হত্যা করার জন্য আমার দিকে তোমার হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য তোমার প্রতি আমার হাত বাড়াবো না। 

কারণ, আমি আল্লাহকে ভয় করি যিনি সৃষ্টিকুলের প্রভু। বরং আমি চাই, তুমি আমার গুনাহ এবং তোমার গুনাহের বোঝা একাই তোমার মাথায় তুলে নাও; আর এভাবেই তুমি জাহান্নামের অধিকারী হয়ে পড়ো। এ হচ্ছে জালেমদের কর্মফল। শেষ পর্যন্ত তার কুপ্রবৃত্তি তাকে নিজ ভাইয়ের হত্যার কাজে উসকানি দিল। একপর্যায়ে সে তাকে খুন করেই ফেলল। এর ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল ‘

ইবরাহিম (আ.)-এর সময়ে কোরবানি

মুসলিম উম্মাহর জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করার মাধ্যমে দ্বিতীয় ইতিহাসের এক নতুন মাত্রা তৈরি হয়। তবে ইসলামে হযরত ইসমাইল (আ.)-এর স্মরণে কোরবানি করা হয়। কেননা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন , কোরবানি হলো তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। 

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত’; সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। 

অতঃপর তারা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে! এভাবেই আমি সৎ কর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি।’ (সুরা আস-সাফফাত, আয়াত : ১০২-১০৫)

হাদিসে কোরবানির র্বণনা

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার সামর্থ্য আছে তবুও সে কোরবানি করল না (অর্থাৎ কোরবানি করার সংকল্প তার নেই) সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (মুসনাদে আহমদ ২/৩২১)


হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরবানি করার জন্য একটি দুম্বা আনতে বললেন, যার শিং রয়েছে, যার পা কালো, পেটের চামড়া কালো এবং চোখ কালো। এ রকম একটি দুম্বা আনা হলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আয়েশা, আমাকে ছুরি দাও। আরও বললেন, একটি পাথরে ঘষে ধারালো করে দাও। 

তিনি ধারালো করে দিলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুম্বাটি মাটিতে শুয়ালেন। এরপর বিসমিল্লাহ বলে জবাই করলেন এবং বললেন, 

হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মাদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৯৬৭)