প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার কারণে বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের কবলে পড়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তিন খাতে এই টাকা তাদের খরচ করতে হচ্ছে।
এগুলো হচ্ছে-নোট-গাইড ও সহায়ক পাঠ্যবই ক্রয় এবং প্রাইভেট-কোচিং। বাণিজ্যের নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করছে বিভিন্ন স্কুল। অসাধু শিক্ষকদের সঙ্গে যোগসাজশ আছে কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। তারাই ওইসব প্রতিষ্ঠানের বই কিনতে বাধ্য করছে।
একইভাবে প্রাইভেট-কোচিংয়েও যেতে বাধ্য করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। কাউকে নিয়মিত ক্লাসের বাইরে স্কুলের কোচিংয়ে পড়ছে বাড়তি অর্থ দিয়ে। আবার কেউ যাচ্ছে শিক্ষকের কোচিং সেন্টারে।
কেউ কেউ গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ছে। আবার কোথাও ব্যবসায়িক কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। প্রতি স্কুল থেকে কত শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে তার আগাম ঘোষণা না দেওয়ায় শতভাগই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা নেওয়া শুরু। যখন বৃত্তি পরীক্ষা ছিল সে সময় নোট-গাইড ব্যবসা আর প্রাইভেট-কোচিং এতটা রমরমা ছিল না।
কেননা, কোনো স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির মোট শিক্ষার্থীর মাত্র একটি অংশকে বৃত্তি পরীক্ষায় পাঠাতে হতো। কিন্তু পিইসি পরীক্ষা চালুর পর শতভাগ শিক্ষার্থীকে অংশ নিতে হচ্ছিল। ওই অবস্থায় পরীক্ষায় ভালো করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর সুযোগ নেন অসাধু শিক্ষকরা। তারা কোচিং আর প্রাইভেটের ফাঁদ পেতে বসেন। পাশাপাশি সারা দেশে প্রচুর সংখ্যক বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টার গড়ে উঠে।
পাশাপাশি রমরমা হয়ে ওঠে নোট-গাইড এবং বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারের মতো সহায়ক বইয়ের ব্যবসা।
২৪ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, পিইসি পরীক্ষা আর হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এখন বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। এর কারণ হচ্ছে, অভিভাবকদের মধ্যে এই পরীক্ষার চাহিদা আছে।
২০২২ সালে যখন প্রথমে কোনো স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির মোট শিক্ষার্থীর ১০ শতাংশকে এই পরীক্ষায় পাঠাতে বলা হয়। তখন অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আরও বেশি সংখ্যকের জন্য দাবি আসতে থাকে। পরে বাধ্য হয়েই তা ২০ শতাংশ করা হয়েছিল।
এছাড়া প্রাথমিকে মেধার স্বীকৃতি হিসাবে বৃত্তি দেওয়ার প্রচলন দীর্ঘদিনের। এটা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিরও অংশ এবং এর মাধ্যমে কিছু শিক্ষার্থীকে অর্থায়ন করা হয়ে থাকে।
তিনি আরও জানান, আগে অভিযোগ ছিল, যেই সংখ্যক শিক্ষার্থীকে এই পরীক্ষায় পাঠাতে হবে তাদের আলাদা করে ক্লাস নেওয়া হতো স্কুলে। এটা করে যাতে ক্লাসের বাকি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্কুল বৈষম্য সৃষ্টি করতে না পারে, তাই এখনই সংখ্যাটা প্রকাশ করা হচ্ছে না। এটা পরীক্ষার এক মাস আগে জানানো হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ২৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। ২০২২ সালে ৫ লাখ ৩৯২ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় অংশ নেয় ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৪ জন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যেহেতু বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর শতাংশ নির্ধারণ করা হয়নি, তাই এখন শতভাগ শিক্ষার্থীই নোট-গাইড এবং সহায়ক বই কিনছে।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পঞ্চম শ্রেণির এক সেট গাইডের দাম ১২শ টাকা। আর বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারের দাম ৭-৮শ টাকা। অন্যদিকে কোনো কোনো শিক্ষার্থী একাধিক কোম্পানির গাইড কিনে থাকে। এমন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে আরও অতিরিক্ত ১২শ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।
সেই হিসাবে এই দুই বইয়ের জন্য একজন শিক্ষার্থী যদি গড়ে ২৪শ টাকা ব্যয় করে তবে অন্তত ৬২৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে অভিভাবকদের। আবার কোচিং এবং প্রাইভেট পড়ার ক্ষেত্রেও মাসে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। যদি শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়ে তাহলে শহর ও গ্রাম নির্বিশেষে মাসে গড়ে ১ থেকে ৫ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। আর কোচিং করতে এই খরচ ১ থেকে ৩ হাজার টাকা হচ্ছে।
যদি ২৫ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০ লাখ শিক্ষার্থী কোচিং-প্রাইভেট পড়ে এবং প্রত্যেকে গড়ে মাসে আড়াই হাজার টাকা ব্যয় হয়। সে ক্ষেত্রে এই খাতে মাসে ব্যয় দাঁড়ায় অন্তত ২৫০ কোটি টাকা। কোচিং-প্রাইভেট পড়ার পেছনে অভিভাবকদের বছরে ব্যয় হয় তিন হাজার কোটি টাকা। সহায়ক বই এবং প্রাইভেট-কোচিং সব মিলে বছরে ব্যয় দাঁড়ায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি।
দেশের একাধিক স্থান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা যুগান্তরকে বলেছেন, কোচিং আর প্রাইভেট পড়ানো থেকে শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। কোথাও অভিভাবকরাই চাচ্ছেন তার সন্তান ভালো করুক। তাছাড়া বর্তমানে অন্তত ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রথম-প্রজন্মের। অর্থাৎ, এসব শিক্ষার্থীর বাবা-মা আগে স্কুলে আসেননি। যে কারণে তারা সন্তানের লেখাপড়া নিজেরা করাতে পারেন না।
এছাড়া বৃত্তি পরীক্ষার প্রশ্নে অভিভাবকরা সন্তানকে দক্ষ করে তুলতে চান। এসব কারণে তারা প্রাইভেট-কোচিংয়ের আশ্রয় নিচ্ছেন। তাই শিক্ষক না চাইলেও এটি ঘটছে। আর কিছু অসাধু শিক্ষক বা কোচিং প্রতিষ্ঠান যে নেই, সেটাও বলা যাচ্ছে না। এই একই কারণে নোট-গাইডও চলছে বলে তারা মনে করেন।
ডিসেম্বরে নেওয়া প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ‘কুফল’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছিলেন দেশের ৩০ বিশিষ্ট নাগরিক।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর পাঠানো ওই বিবৃতিতে বলা হয়, পুরোনো ব্যবস্থার মতো পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
এতে শিক্ষার্থীদের ওপর নানামুখী মানসিক ও শারীরিক চাপ পড়বে। তারা বৃত্তি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষার পরিবর্তে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর দিক-নির্দেশনার আলোকে সব শিক্ষার্থীর জন্য উপজেলাভিত্তিক বাছাইয়ের মাধ্যমে মেধা বৃত্তি প্রদানের পরামর্শ দেন। কিন্তু এসব উপেক্ষা করেই ৩০ ডিসেম্বর পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। পরে এই পরীক্ষার ফল নিয়ে কেলেঙ্কারিও ঘটে।
এ নিয়ে আলাপকালে রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এই পরীক্ষার কারণে নোট-গাইড এবং কোচিং উভয় ব্যবসাই বেড়ে যাবে, যা পিইসি পরীক্ষা ২ বছর না নেওয়ায় বন্ধ হয়েছিল। পাশাপাশি এ ধরনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আঁতাত আছে কিনা-তাও ভেবে দেখার পরামর্শ দেন।