১৮ আগস্ট ২০১৮ মৃত্যুবরণ করেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। জন্মসূত্রে ঘানার বাসিন্দা হলেও তিনি ছিলেন একজন বিশ্ব নাগরিক। আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০০১ সালে পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। বিভিন্ন সম্মেলনে, সমাবর্তন বক্তৃতায় সব সময় তিনি তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছেন।
গত বছর নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনালের বৈশ্বিক সভায় তিনি বিশেষ অতিথি ছিলেন। ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর, সেই অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতাটি আজ ছাপা হলো বিশিষ্ট অতিথি, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়, জেসিআইয়ের (জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল) বৈশ্বিক সম্মেলনে অংশ নিতে পেরে আমি আনন্দিত। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য জেসিআইকে ধন্যবাদ।
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা দেশের তরুণ নাগরিকেরা আজ এই কক্ষে এক হয়েছে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমি সম্ভাবনার একটা ইতিবাচক শক্তি অনুভব করতে পারছি। পৃথিবীর জন্য আরও টেকসই একটা ভবিষ্যৎ গড়তে তোমাদের এই তারুণ্যের শক্তি, সৃজনশীলতা ও গভীর আবেগ আমাদের প্রয়োজন। আমরা একটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
সহিংস সংঘর্ষ, সন্ত্রাস, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক বিভেদ, অর্থনৈতিক অসমতা—প্রতিনিয়ত এমন আরও নানা পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সমাজ। এসব সমস্যারও ঊর্ধ্বে মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের জন্য একটা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। অত্যন্ত জটিল এই বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজার আশায় আমরা আজ তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছি। তোমাদের দিকে তাকিয়েই ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হওয়ার সাহস পাই।
আজ বিশ্বের জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ হলো তরুণ। এই তরুণদের একটা বড় অংশই শান্তি, টেকসই উন্নয়ন ও মানবতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। আমার জীবনে আমি বহু তরুণদল, ছাত্রসংগঠন, তরুণ নেতার মুখোমুখি বসেছি, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মেধা, জ্ঞান, একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ার যত ভাবনা, সব সময় আমাকে অবাক করেছে।
নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে তোমাদের প্রজন্ম অনেক বেশি মুক্তমনা, তোমরা বিশ্ব নাগরিক। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো প্রজন্মের জন্যই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকাটা এত সহজ ছিল না। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার প্রজন্ম যা অর্জন করতে পারেনি, তোমরা তা করে দেখাবে।
সামনের চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বড়। নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবতে পারো কারণ, একেবারে গোড়া থেকে তোমাদের শুরু করতে হচ্ছে না। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি তোমাদের পথ দেখাবে। একটা সুন্দর পৃথিবী পেতে হলে কী করণীয়, সে সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা সামনে উপস্থাপন করা আছে।
দৃঢ় সংকল্প ও কল্পনাশক্তির সাহায্যে সেই পৃথিবী গড়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া এখন তোমাদের দায়িত্ব। সরকার, ব্যবসায়ী, সুধী সমাজ ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে এই লক্ষ্যে এক হতে হবে। আর এই যাত্রায় আমাদের নেতৃত্ব দেবে তরুণেরা। পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করার জন্য তোমাদের শক্তি ও দক্ষতা কীভাবে কাজে লাগতে পারে, এ সম্পর্কে আমার কিছু ভাবনা আজ উপস্থাপন করতে চাই।
প্রথমত, আমি বিশ্বাস করি, শান্তি, সমন্বয় ও মানবাধিকারের জন্য তোমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের আজ খুব প্রয়োজন। সশস্ত্র সংঘর্ষে পৃথিবীর নানা প্রান্তে হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে, লাখো মানুষ হচ্ছে বাস্তুহারা। এই অন্যায় পৃথিবীর মানুষের সম্মিলিত নীতিবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিভেদ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। পুরো সমাজটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করছে।
আর এসব কারণে বিশেষ ঝুঁকির মধ্যে আছে তরুণ সমাজ। সহিংসতা ও বিভেদের কারণে বিশ্বের একেক জায়গার তরুণদের ওপর একেক রকম প্রভাব পড়ছে। কখনো তারা অপরিপক্ব সৈনিক হিসেবে জুলুমের শিকার হচ্ছে, কখনো যোগ দিচ্ছে বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসীদের দলে। এরপরও তরুণেরাই হতে পারে শান্তির সপক্ষে সবচেয়ে বড় শক্তি। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমরা সবাই একই নৌকার যাত্রী।
এই যাত্রীদের মধ্যে ‘ওরা’ আর ‘আমরা’ বিভাজন তৈরি করে কখনোই শান্তি ও উন্নয়ন আনা যাবে না। তোমরা জানো, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ গড়তে চাইলে দ্বন্দ্ব ভুলে যেতে হয়। আমদের দুর্দশার ব্যাপারে যখন আমরা সবাই একমত হব, তখনই সেটা ভবিষ্যতের জন্য একটা বিনিয়োগ হবে। এই চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে লড়ার অনেক সরঞ্জাম তোমাদের হাতে আছে। যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মানবাধিকার সংরক্ষণ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তোমরা এই শক্তি কাজে লাগাতে পারো।
দ্বিতীয়ত, আমি তোমাদের একটা নিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করব, যেখানে সবাই নিজেদের উন্নয়নের জন্য সমান সুযোগ পাবে। বিশ্বায়ন একদিক থেকে যেমন মানুষকে অভূতপূর্ব সম্পদের অধিকারী হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে, তেমনি একই সঙ্গে অসমতাও গড়ে উঠছে প্রবলভাবে।
একদিকে সারা বিশ্বের দরিদ্র সম্প্রদায়ের অর্ধেকের সম্পদ এক করলে যা দাঁড়ায়, অন্যদিকে সেটা বিশ্বের ৮ জন মানুষের সম্পদের যোগফলের সমান। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিভেদ এবং সমাজের অসমতার কারণে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের বিশ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছে। একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার প্রতি মানুষের ভয়কে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ লাভবান হচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটা সত্যিকার বৈশ্বিক প্রজন্ম হলে তোমরা।
তোমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারো, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় কিংবা জাতিগত বৈচিত্র্য আমাদের জন্য বিভেদের কারণ নয়; বরং একটা বড় শক্তির উৎস হতে পারে। তরুণেরা আমাকে আশাবাদী করে। বর্ণবাদ, চরমপন্থা ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বলার শক্তি তো তোমাদেরই আছে। সে জন্যই আমার সংস্থা ‘এক্সট্রিমলি টুগেদার’ নামে একটা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। চরমপন্থার বিরুদ্ধে তরুণেরা কীভাবে অবস্থান নিতে পারে, এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা সেই পথ দেখানোর চেষ্টা করছি।
মানসম্মত শিক্ষা কিংবা তরুণী-তরুণীদের উন্নত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে, তোমাদেরই সেসব বাধা দূর করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তরুণেরা যেন অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, সমাজের নীতিনির্ধারকদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, পরিবেশ রক্ষায় তোমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বহু বছর ধরে আমরা এমন অপরিকল্পিতভাবে পৃথিবীর সম্পদগুলো ব্যবহার করে আসছি, যেন ‘আগামীকাল’ বলে কিছু নেই। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে।
সারা পৃথিবীতেই খরা, অগ্ন্যুৎপাত, ঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের খাদ্য উৎপাদন, পরিষ্কার পানির সরবরাহের ওপর হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়ছে, মানুষের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে একটা পুরো শহর কিংবা বিভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্র ডুবে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যে আমরা বসবাস করছি।
বহু মানুষকে হয়তো তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে হবে। সবচেয়ে দরিদ্র যারা, এই পরিবেশ বিপর্যয়ের পেছনে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে নগণ্য, তাদেরই সবচেয়ে বেশি মাশুল দিতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক সংকট সমাধানের দায়িত্ব আমরা কেবল সরকারের ওপর ছেড়ে দিতে পারি না। আমাদের পৃথিবী রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। এই লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, এমন অনেক নেতৃত্বের উদাহরণ আমাদের সামনে আছে।
টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে সুশীল সমাজ ও যুব আন্দোলন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। সারা পৃথিবীতেই তারা বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও সরকার যেন পরিবেশ রক্ষায় তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে, সে জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। সচেতন ভোক্তা হিসেবে তরুণেরাও পৃথিবীর সম্পদগুলো সঠিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। সবুজ বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা নানা রকম উদ্যোগ নিচ্ছে, সেবামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে।
প্রিয় বন্ধুরা, আমি বিশ্বাস করি, আমরা একসঙ্গে এখন থেকেই কাজ শুরু করলে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। সমস্যাগুলো বৈশ্বিক। কিন্তু সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে স্থানীয়ভাবে কাজ করতে হবে। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে পরিবারে খাবার টেবিলে, নিজ নিজ সম্প্রদায়ে তোমাদের উদ্যোগ আজ অপরিহার্য।
আগামী কয়েক দিনে তোমরা আমাদের সময় বড় বড় সমস্যা ও নেতৃত্ব বিষয়ে একে অপরের সঙ্গে কথা বলবে। একজন ভালো নেতা একজন ভালো শ্রোতাও বটে। সে জানে, কাকে অনুসরণ করতে হয়। যদি নেতা হতে চাও, তাহলে এ কথা মনে রেখো। একটা কথা আমি সব সময় বলি, নেতৃত্ব না দিতে পারার মতো ছোট যেমন তুমি নও, তেমনি যত বুড়োই হও না কেন, শেখার কোনো শেষ নেই।
তুমি তেমন নেতাই হতে পারো, যেমনটা আজ আমাদের প্রয়োজন। সেই সুযোগ তোমার আছে। অতএব তোমার শক্তি, আবেগ, দূরদৃষ্টিকে মানুষ ও পৃথিবীর সেবায় কাজে লাগাও। আরও টেকসই একটা ভবিষ্যৎ পাওয়ার অপেক্ষায় আজ আমরা তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছি।
ধন্যবাদ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ সূত্র: কফি আনান ফাউন্ডেশনের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট