বাদাম প্রিয় মানুষের সংখ্যার অভাব নেই। আমরা অনেকেই অবসরে বা বিনোদনে কিংবা গল্প আড্ডার ফাঁকে এই বাদামকে পছন্দের তালিকায় রাখি। এজন্য চীনাবাদামকে টাইমপাস ফুড বলা হয়ে থাকে।
চীনাবাদাম, নাম শুনে যেন মনে হয় চীন থেকে এর উৎপত্তি। আসলে এটি প্রথম দেখা মেলে দক্ষিণ আমেরিকায়। কিন্তু কত বছর আগে তার কোন সঠিক ধারণা নেই। তবে এটি যে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে সে ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই।
চীনাবাদাম ইউরোপে নিয়ে আসে স্প্যানিশরা। এরপর সেখান থেকে ব্যাবসায়ীরা নিয়ে যায় আফ্রিকায়,তারপর আসে আমেরিকায়। যুক্তরাষ্ট্রে এই বাদামের প্রচলন শুরু হয় গো-খাদ্য হিসেবে। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় খাদ্যাভাবে অনেকেই বাদাম খেতে শুরু করে। এরপর যুদ্ধশেষে পিটি বারনাম নামক একজন ব্যক্তি সার্কাসে বাদাম ভেজে বিক্রি করে। সার্কাসের এই বাদাম সবাই এত পছন্দ করে যে, তখন থেকে ভাজা বাদাম খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন এবং ফেরি করে বিক্রি শুরু হয়। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পরে এই বাদাম।
আমাদের দেশে বাদামের চাষাবাদ কখন থেকে শুরু হয় তার সমীকরণ না থাকলেও, এই বাদামই টাঙ্গাইলের চর এলাকার মানুষের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। টাঙ্গাইলের পাশে যমুনা এবং ধলেশ্বরী নদীর স্রোতের কারণে অনেক মানুষকে সহায় সম্বলহীন হতে হয়েছে। সেখানে চাষাবাদের উপযোগীও ছিলোনা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই চর যখন ভেসে উঠে, তখন তা চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষের নিকট হাসির কারণ হয়। এরপর তারা সেখানে বাদামের চাষ শুরু করে এবং বাদামের খুব ভালো ফলন দেখতে পায়। যে নদী ভাঙনে ভাসিয়ে নিয়েছে কত মানুষের সম্পদ,সেই নদীতে ভেসে উঠেছে চর। অনেকটা এলাকা জুড়েই শুধু বিস্তীর্ণ চর এলাকা। এই চর হয়ে উঠেছে এখন অনেকের অবলম্বন। তাই চরের কৃষকরা বাদামকে ভালোবেসে নাম দিয়েছে গুপ্তধন।
টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের চর এলাকায় প্রচুর বাদামের ফলন হয়। এছাড়াও সদর,কালিহাতি এবং নাগরপুরের কিছু কিছু জায়গাতেও এর ব্যাপক ফলন হয়। শুধুমাত্র ভূয়াপুর উপজেলার গাবসারা, সরইপাড়া, চরতাড়াই, চর ভরুয়া, বলরামপুর, কুঠিবয়রা, রামাইল, বাসুদেবকোল, বেলটিয়াপাড়া, ভদ্রশিমুল, জুংগিপুর, নলছিয়া, পলশিয়া, চিতুলিয়াপাড়া, রামপুর, কালিপুর, ডিগ্রিচরসহ আরো বেশ কিছু গ্রামে চাষ হয় বাদামের। শুধু মাত্র ভুয়াপুরের চর অঞ্চলেই ১৮৫০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হচ্ছে।
যমুনা এবং ধলেশ্বরীর চর এলাকা গুলোতে বালুর আস্তরণে এক সময় জমিগুলো অনাবাদী থাকতো। বালু মাটিতে ফসলের চাষ হয় না, তাই সেদিকে কেউ নজড় দিত না। এরপর কিছু জায়গায় এক সময় তামাক উৎপন্ন হলেও এখন সবাই বাদামের চাষ করে। সেই অনাবাদী জমি গুলোতেই এখন বাদামে উৎপাদনের সময় সবুজের সমারোহে ভরে থাকে। নভেম্বর মাসের দিকে জমিতে বাদামের বীজ বোনা শুরু হয়। এরপর মার্চ এপ্রিলের দিকে এর ফলন আসে। এই সময় যমুনার চর একেবারে সবুজে ঘিরে থাকে। বাদাম চাষে কষ্ট কম,রোগ বালাই কম,তাই চাষীরা এ নিয়ে সন্তুষ্ট ।
দেশি বাদামে ফলন কম হলেও বারি ৮ উচ্চ ফলনশীল বীজে বাদাম প্রায় দ্বিগুণ হয়। এসব বীজের ফলন প্রক্রিয়াও যত্ন নিয়ে টাঙ্গাইলের চাষীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে । যা চাষীদেরকে বাদাম চাষে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এছাড়াও ফলনে খরচ কম হওয়াই চর এলাকার চাষীদের জন্য তা অত্যন্ত ভালো দিক। কৃষকেরা বাদামের ফলনে এত বেশি খুশী যেন বালুর নীচে সোনা লুকিয়ে থাকে। আর এই আনন্দ তারা উপভোগ করে বাদাম তোলার সময়।
তবে টাঙ্গাইলে সরকারি ভাবে বাদাম ক্রয় বিক্রয় কেন্দ্র নেই। এরফলে চাষীদের ফড়িয়া কিংবা দালালের কাছে বাদাম বিক্রি করতে হয়। যদি উপযুক্ত মাধ্যম থাকতো তাহলে হয়তো বাদাম থেকে আরও লাভবান হতো কৃষকরা।
খুব কম খরচে আবাদকৃত এই ফসল যেমন মুখরোচক ও ভিটামিনসমৃদ্ধ, তেমনি এটি খাবারে পাশাপাশি যোগান দেয় তেলেরও। বাদামের কচিপাতা ছাগলের জন্য বেশ উপকারী খাবার। যা এজাতীয় প্রানিদের স্বাস্থ্য উন্নত করে তোলে। সব মিলিয়ে বাদাম চাষীরা ভীষণ আনন্দিত।
বাদাম আমাদের দেশে মুখরোচক খাবার হিসেবে ভেজে খাওয়া হয়। কিন্তু এতে যেহেতু ৪৮ থেকে ৫০ ভাগ তেল থাকে, তাই এটি পরিমাণে বেশি উৎপন্ন করা গেলে তেলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাদামের তেল খুব উপকারী এবং পৃথিবীর অনেক দেশেই এই তেল খাওয়া হয়। এছাড়াও বাদাম দিয়ে তৈরি করা যায় আটা। যা দিয়ে রুটি বানানো ও প্যানকেক বানানো যায়। বাদাম থেকে উৎপাদিত এসব খাদ্য নিঃসন্দেহে পুষ্টিকর। বাদামের ভর্তাও খেতে বেশ মজাদার। বাদাম টানা হিসেবে খাওয়া যায় এবং এই টানাও হতে পারে অনেক বড় সম্ভাবনা। এটি বাচ্চাদের হোমমেইড সেরেলাক তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। বাদাম ভেজে কিংবা ভিজিয়ে শরবত তৈরি করে খাওয়া যায়,যা খুবই উপকারী। তবে হজমে সমস্যা হচ্ছে কিনা এদিকে শুধু খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
শুধু তাই না বাদামের রয়েছে অনেক উপকারীতা।
যেমন :
- বাদামের ভেতর থাকে ফসফরাস যা হাড়ের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত বাদাম খাওয়ার অভ্যাস মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
- বাদামে উপস্থিত এন্টি অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- বাদামে উপস্থিত ম্যাগনেসিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং ডায়বেটিস রোগীদের জন্যও ভালো।
- বাদামে প্রচুর পরিমানে ক্যালরি এবং চর্বি থাকে তবে যা শরীরের জন্য উপকারী।
- এতে উপস্থিত কো এনজাইম হার্ট কে অক্সিজেনের অভাব থেকে রক্ষা করে।
- বাদামে ভিটামিন ই থাকায় তা চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
এক বাদামের অনেক গুণ। চাষের উপযোগী জমিও রয়েছে। উপযুক্ত মাধ্যম পেলে বাদাম নিয়ে লেখালেখির মাধ্যমে এর প্রতি সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে। টাঙ্গাইলের প্রচারণার জন্য ই-কমার্স সবথেকে উপযোগী মাধ্যম।
বর্তমান সময়ে আমরা ওতপ্রোতভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। কিন্তু পর্যাপ্ত কন্টেন্টের অভাবে দেশীয় অনেক খাত চাপা পরে রয়েছে। আমরা অনেক সময় জানিই না কোন জেলায় কি পণ্য হচ্ছে। অথচ এগুলো নিয়ে কাজ করে সফলতার দ্বার উম্মুক্ত করা যেতে পারে।
এভাবেই আমাদের দেশীয় এমন পণ্যের প্রচারে এগিয়ে আসতে হবে এবং চাষীদের পাশে দাড়াতে হবে। নিজ উদ্যোগ নিয়ে প্রচুর কন্টেন্ট লিখতে হবে। ই-কমার্স এর হাত ধরে এসব কন্টেন্টগুলি ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই টাঙ্গাইলসহ পুরো দেশের অনেক সম্ভাবনাময় খাত গুলো উঠে আসতে পারবে ইন শা আল্লাহ।
লেখক : স্বত্বাধিকারী, ইপ্পি শপিং