মন্দা উত্তরণে সহায়ক হতে পারে সুনীল অর্থনীতি

অর্থনীতি

বিশ্বব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর ৯০ ভাগই ২০২২ সাল নাগাদ মহামারির আগের অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরে যাবে। পর্যাপ্ত টিকা প্রাপ্তির কারণে ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি এত বেশি দ্রুত বেড়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর উত্তরণের গতি অনেক ধীর। ফলে মহামারি-পরবর্তী বিশ্বে ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য অনেক বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য সমুদ্র সম্পদ আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় সহায়ক।

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সমুদ্র সম্পদ আহরণের প্রতি জোর দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন। এখনো বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র চার থেকে পাঁচ শতাংশ ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি থেকে আসে। এটার পরিমাণ বার্ষিক ৯৬০ কোটি ডলার। তবে এই খাত থেকে আয়ের সম্ভাবনা অবারিত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো আয় হয়। সমুদ্রের শুধু মাছ রপ্তানি থেকেই ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। অনেকে সমুদ্র অর্থনীতি সম্পর্কে খুব ভালো জানেন না। তাই তারা বিনিয়োগ করতে চান না। আবার কেউ কেউ মনে করেন, রাষ্ট্রীয় পলিসি এ খাতে বিনিয়োগে সহায়ক নয়। সমুদ্র-যোগাযোগ পথ ও সমুদ্র পরিবহন, মত্স্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ, জ্বালানি নিরাপত্তা, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা শিল্প, দক্ষ জনবল সরবরাহ, পর্যটন ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে সমুদ্র সম্পদ আহরণ করা যায়। ব্লু ইকোনমি থেকে বিপুল আয়ের অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু কাজে লাগানো যাচ্ছে খুব সামান্য। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার পর বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশ বছরে ৯৬০ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ করছে। যদিও সম্ভাবনা আকাশচুম্বী। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে বছরে আড়াই লাখ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ সম্ভব। সমুদ্র সম্পদ আহরণে সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবে বিপুল সম্ভাবনা হাতছাড়া হচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্র খাতে বিনিয়োগ সীমিত। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার প্রায় সাত বছর পরও সমুদ্র সম্পদ আহরণে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ছিটেফোঁটা কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়নের গতি খুবই ধীর। কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে সমুদ্র সম্পদ আহরণে সব উদ্যোগ বলতে গেলে থেমে গেছে। বঙ্গোপসাগর আমাদের অর্থনীতির জন্য অনেক সম্ভাবনার আধার হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। মূল্যবান খনিজ সম্পদ ইউরনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বাংলাদেশের অগভীর ও গভীর সমুদ্রের তলদেশে। ১৩টি জায়গায় আছে সোনার চেয়ে দামি বালি। যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমানাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট। অগভীর সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট তৈরির অন্যতম কাঁচামাল ‘ক্লে’র সন্ধান পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে ইলমেনাইট, গার্নেট সিলিমানাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট সমৃদ্ধ ভারী খনিজ বালু পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সমুদ্র ভাগেও বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ রয়েছে। ব্লু ইকোনমি ও নীল সমুদ্রের অর্থনীতির সম্ভাবনা সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে এ সব তথ্য জানা গেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অগভীর সমুদ্রের তলদেশে কোবাল্ট, ভানাডিয়াম, মলিবডেনাম ও প্ল্যাটিনাম নামে গঠিত ম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট এবং তামা, সিসা, জিংক, কিছু পরিমাণ সোনা ও রূপা দিয়ে গঠিত সালফাইডের অস্তিত্ব রয়েছে। এ সব অতি মূল্যবান সম্পদ সমুদ্রের ১ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৭০০ মিটার গভীর তলদেশে রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশ শুধু অপার খনিজ সম্পদেই পূর্ণ নয় ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীরতায় এক ধরনের ক্লের সন্ধান পাওয়া গেছে। অগভীর সমুদ্রের এই ক্লে উত্তোলন করা গেলে বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্পে বিপ্লব ঘটে যাবে। কারণ ক্লে সিমেন্ট উত্পাদনের অন্যতম কাঁচামাল। সাগরে মূলত দুই ধরনের সম্পদ রয়েছে। এগুলো হলো—প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ। প্রাণিজ সম্পদের মধ্যে মত্স্য ও সামুদ্রিক নানা প্রাণী, লতাগুল্ম প্রভৃতির কথা বলা যায়। বঙ্গোপসাগরে মত্স্য আহরণে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্টভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। যদি পরিপূর্ণভাবে বঙ্গোপসাগরে মত্স্য সম্পদসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী মূল্যবান লতাগুল্ম আহরণের মাধ্যমে এগুলো যথাযথ প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে রফতানি পণ্য তালিকায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে পারে।

বাংলাদেশের মিঠা পানিতে যেখানে ২৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, সেখানে বঙ্গোপসাগরে রয়েছে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। কিন্তু আমরা এসব মাছ আহরণ করতে পারছি না। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে প্রচুর লবণ উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমিতে বেসরকারি বিনিয়োগ পর্যাপ্ত নয়। ব্লু ইকোনমিতে কিছু কিছু বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে। বিশেষ করে মাছ ধরার ট্রলার, সমুদ্র ভ্রমণে পর্যটন, মালামাল পরিবহন, আরো অনেক খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে বিনিয়োগে মানুষকে আগ্রহী করে তোলার জন্য ব্র্যান্ডিং ঠিকমতো হচ্ছে না। তবে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা বাস্তবায়নে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা আমাদের সবাইকে আশাবাদী করে তুলেছে।