ফাতেমা তুজ জোহরা,জন্ম ও বেড়ে উঠা পাহাড় ঘেরা বান্দরবানে। চার ভাই বোনের মধ্যে পরিবারের তৃতীয় সন্তান তিনি। পড়াশোনায় অর্থনীতিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন ফাতেমা। পাশাপাশি হয়ে উঠেছেন একজন উদ্যোক্তা । ফাতেমার ব্যবসার শুরু সম্পূর্ণ অনলাইনকেন্দ্রিক। ফেসবুকে পেজ মিনাফিয়াবিডির মাধ্যমেই হয়ে যান অনলাইন উদ্যোক্তা। এখন তাদের ওয়েবসাইট থাকলেও ব্যবসার বেশীরভাগ বিক্রি হয় ফেসবুকেই।
মূলত তার ব্যবসাটা ছিল একটি পারিবারিক উদ্যোগ । ভাই-বোনরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিছু একটা করার। যদিও তাদের এখন মনে হচ্ছে আরও অনেক আগেই ব্যবসা শুরু করা উচিত ছিল। সম্প্রতি রাইজিংবিডিতে তিনি তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প বলেছেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক ফাতেমার উদ্যোক্তা হওয়ার আদ্যপান্ত –
ব্যবসার শুরু-
ব্যবসার প্রথম শুরুটা ছিল বেবি কাঁথা দিয়ে। লক্ষ্যই ছিল বাচ্চাদের পণ্য নিয়ে কাজ করবো। প্রথম দিকে কোন টাকা ছাড়াই সুন্দরবনের পলিতে পণ্য পাঠিয়ে দিতাম। পণ্য হাতে পাওয়ার পর ক্রেতারা বিকাশে টাকা পাঠাতো। যদিও পরে ফুল পেমেন্ট এডভান্স করার পর প্রোডাক্ট পাঠানো শুরু করেছি। আমাদের প্রথম ক্রেতা ছিলেন সদ্য মা হতে যাওয়া এক নারী। এ পর্যন্ত আমার পেজ থেকে সাত বারের বেশি পণ্য নিয়েছেন তিনি। আমাদের টার্গেট থাকে রিপিট কাস্টমার তৈরি। যাতে একই জন নিজ থেকেই খুশী হয়ে আবার প্রোডাক্ট নেন।
যেসব পণ্য নিয়ে কাজ করছি-
বাচ্চাদের জন্য আমরা অনেক পণ্যই কিনতাম। কিন্তু বান্দরবান মফস্বল শহর হওয়াই এখানে মানসম্পন্ন পণ্য সবসময় মিলত না। বেবির জন্য কোনটা ভালো এটা জানার জন্য গুগল সার্চ দিতাম। অ্যামাজন,আলী বাবা সাইটগুলো দেখতাম ও ফিচার পড়তাম। অনেক সময় চট্টগ্রাম বা ঢাকায় গিয়ে বাছাই করে কিনতাম। এভাবেই বেবি প্রোডাক্ট সম্পর্কে ভালো একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। বেবিদের ফ্রক,নিমা,ফতুয়া,বেবি শাড়ি,বেবি পান্জাবি অর্থাৎ বেবিদের প্রয়োজনীয় প্রোডাক্টই মেইন ফোকাস। ফেসবুক গ্রুপ উইতে ( উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম ) প্রথম দিকে যারা খুব সরব ছিল, তাদের মধ্যে বেবি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। তখন থেকেই আমি ব্যবসা করছি।
বিব্রতকর অভিজ্ঞতা :
প্রথম দিকে অনেক বেশি পণ্য কেনাটা বোকামি হবে ভেবে বিভিন্ন দোকান থেকে পণ্য সম্পর্কে ধারণা নিয়ে অল্প কিছু কিনতাম। আর মাঝে মাঝে যাচাই করতে প্রোডাক্টের ছবি তুলে আনতাম। একবার এক দোকানে এক প্রোডাক্টের ছবি তুলতে যাই সরল মনে। কিন্তু ওই দোকানদার যিনি একজন মহিলা তিনি রেগে গিয়ে বললেন,ছবি তুলতে পারবেন না। সেদিন লজ্জা পেয়েছিলাম। বান্দরবানের মত জায়গায় কোন দোকানে ছবি তুলতে নিষেধ করবে এটা ভাবি নাই। এটা প্রথম দিকের কথা। তখন প্রোডাক্টের ছবি তুলতে বাধা দেওয়ার ঘটনা সেভাবে হতো না। যদিও এখন আগেই অনেক দোকানে বলে দেওয়া থাকে ছবি তোলা যাবে না।
এছাড়াও প্রথম দিকে আমাদের বড় সমস্যা ছিল বান্দরবান থেকে পণ্য পাঠানো। তখন বান্দরবান সুন্দরবন কুরিয়ার অফিস থেকে ক্যাশঅনে পণ্য পাঠানো যেতো না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্রেতারাই চাইতো ক্যাশঅন ডেলিভারিতে পণ্য নিতে। এরফলে অনেককে পণ্য পাঠানো সম্ভব হতো না।
অন্যান্য উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ :
যারা অনলাইনে ব্যবসা করতে চান তাদের অনেক ধৈর্য্য থাকতে হবে। বুঝতে হবে শর্টকাট কোন পথ নেই। পরিশ্রম করতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার সৎ থাকতে ও কমিটমেন্ট রক্ষা করতে হবে। আমি জানি আমার পণ্য ক্রেতারা তিন দিনে পাবে না, তারপরও ক্রেতাকে মিথ্যা আশ্বাস দিলাম তিন দিনে পাবে। এমন যেন না হয়। সত্যটা বলে রিপিট কাস্টমার তৈরি করতে হবে। এজন্য কাস্টমারের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে।
ব্যবসায় সফল হতে যাদের ভূমিকা :
এগিয়ে যাচ্ছি অনেকের দোয়া ও ভালোবাসা নিয়ে। ভাই বোনরা সবাই মিলে ব্যবসার কাজ ও পেজ পরিচালনা করি। এতে সবচেয়ে বড় লাভ হচ্ছে দূরত্ব হলেও ভাই বোনদের সঙ্গে সম্পর্কে ঘাটতি হচ্ছে না। শ্বশুর বাড়ীর লোকজনও অনেক বেশি সাপোর্ট দিচ্ছেন। পেজ শুরুর প্রথম দিকে আমার স্বামী যেখানেই গিয়েছেন আমার পেজ এবং ব্যবসা সম্পর্কে সবার কাছে বলেছেন। আমার শাশুড়িও ঠিক একই কাজ করেছেন। এগুলো অনেক বেশি অনুপ্রেরণার।
লক্ষ্য ও পরিকল্পনা :
মিনাফিয়া থেকে প্রোডাক্ট ৬৪ জেলা গেছে। লক্ষ্য হচ্ছে গ্রাম পর্যায়েও মিনাফিয়ার প্রোডাক্ট পৌঁছানো। আর রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা অনেক বেশি বাড়ানো।
সফলতার গল্প :
বড় সফলতা সেভাবে অর্জিত না হলেও ছোট ছোট অনেক সফলতা এসেছে। কাস্টমাররা যখন অনেক ভালো ভালো রিভিউ দেয়,খুশী হয় তখন। মনে হয় সফলতার পথেই আছি। দেশের বাইরে থেকেও প্রোডাক্ট নিতে যখন আগ্রহ প্রকাশ করে, তখনও মনে হয় অনেক দূর যাবে মিনাফিয়া। আরেকটা ব্যাপার বেশ আনন্দের। আমাদের রির্টান পার্শেলের সংখ্যা জিরো। কারন আমরা অনেক ভেবে চিন্তে অর্ডার কনফার্ম করি। সব অর্ডার নেওয়া হয় না। আর প্রোডাক্ট পাঠানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকি। আগে সব সুন্দরবন কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এখন স্টিডফাস্ট কুরিয়ারের সঙ্গে কাজ করা হয়। স্টিডফাস্ট কুরিয়ারের হাব ম্যানেজারতো জিজ্ঞেসই করে,অন্যদের এতগুলো রিটার্ন পার্শেল যায়। সেক্ষেত্রে আপনার রিটার্ন পার্শেল যায় না। ঘটনা কী?
মার্চের শুরুতে টার্গেট করেছিলাম বাটিকের নিমা ১০০০ পিস সেল করবো এই বছর,এপ্রিলের মাঝামাঝিতেই টার্গেট পুরণ। আলহামদুলিল্লাহ।
ব্যবসার সময়কাল ও আয় :
প্রায় তিন বছরের মতো ব্যাবসা করছি। আমরা অনেক দেখে শুনে অর্ডার কনফার্ম করি। আমাদের সামনে অনেক বড় কিছু পরিকল্পনা আছে। মাসে একশ থেকে দেড়শ পার্শেল যাচ্ছে। এটাকে বড় সংখ্যায় নেওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি।
লেখকঃ স্বত্ত্বাধিকারী,এস এস এগ্রো প্রোডাক্ট, জেলা প্রতিনিধি উই (রাংগামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) এবং জেলা কন্ট্রিবিউটর