ব্যাটারী, বিদ্যুত ছাড়া চলে তার বোতল বাতি

উদ্যোক্তা

প্লাস্টিকের বোতল। মাঝখান দিয়ে কাটা। সেই বোতলের মধ্য দিয়ে আলোকিত হয় এমন সব ঘর, এমন সব বাড়ি—যেগুলোতে দিনের বেলাতেও থাকে ঘুরঘুট্টি আঁধার। বস্তি বাড়ি। সেসব বাড়িতে বসানো হয় বোতল বাতি। একটা-দুটা নয়, চার হাজার। বিদ্যুৎ, ব্যাটারি—কিছুরই দরকার নেই। সূর্যালোক যেন চুইয়ে পড়ে ঘরের ভেতর। বছর কয়েক আগে প্রাকৃতিক আলোর এই ব্যবহার বেশ সাড়া ফেলে। সাড়া ফেলেন বোতল বাতির পেছনের কারিগর সাজিদ ইকবাল আর তাঁর প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ।

সাজিদ ও তাঁর চেঞ্জের কাজ গত মাসে আবারও সাড়া ফেলল—এবার আন্তর্জাতিক পরিসরে পেল নতুন মাত্রার স্বীকৃতি। ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ (ত্রিশের নিচে ত্রিশ)—বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস-এর একটি তালিকার শিরোনাম। এমন তালিকা নিয়মিতই প্রকাশ করে ফোর্বস। এবারও করেছে। মার্চ মাসে ৩০ বছরের নিচে ৩০ সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগের তালিকা প্রকাশ করেছে সাময়িকীটি। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৭ দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা আছেন এতে। বাংলাদেশের দুজন স্থান পেয়েছেন এবার। একজন সাজিদ ইকবাল, অপরজন টেন মিনিটস স্কুলের আয়মান সাদিক।

সাজিদকে জিজ্ঞেস করলাম, ফোর্বস-এর তালিকায় আপনার নাম কেন উঠল বলে মনে করেন? ‘আগামী ৩০ বছর এবং তারপরও প্রভাব ফেলবে এমন উদ্যোগগুলোকে বিবেচনায় নেয় ফোর্বস। আমি নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করি। সেটাকেই তারা মূল বিবেচনায় রেখেছে বলে মনে হয়।’ বললেন সাজিদ।

তো এখন কী করছেন? ভাবতে সময়ই নিলেন না। ত্বরিত জবাব সাজিদের, ‘প্রাকৃতিক আলো নিয়ে কাজ করি। এখন আমরা কারখানার বাতি নিয়ে কাজ করছি।’ এই বাতির নাম দিয়েছেন সূর্যবাতি বা পাইপলাইট । বেশির ভাগ কারখানায় সূর্যালোক ঢোকে না। বৈদ্যুতিক বাতিই ভরসা, দিনের বেলাতেও কারখানায় জ্বলছে কয়েক হাজার বৈদ্যুতিক বাতি। যেসব কারখানা একতলা, টিনে ছাওয়া—সেসবই আপাতত লক্ষ্য সাজিদের। টিনের ছাদের একটা অংশ কেটে পলি কার্বনেট শিট বসানো হয় প্রথমে। এরপর থাকে পাইপ। পাইপের নিচে ডিফিউজার। সূর্যের আলো দিয়ে সূর্যবাতি আলোকিত করে কারখানার ভেতরটা। একটা বাতি ১০০০ বর্গফুট জায়গা আলোকিত করতে পারে।

সাজিদ একটা হিসাব দিলেন। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানার ১ শতাংশেও (প্রায় ১৮০টি) যদি এই বাতির ব্যবহার করা যায়, তবে ১৬ গিগাওয়াট বিদ্যুতের সাশ্রয় করা যায়। সূর্যবাতি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সাভারের মার্কস আইসক্রিম কারখানায়।

জার্মানির জিটিজেড সাজিদ ইকবালের চেঞ্জে কারিগরি সহায়তা করেছে। নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য যে প্রযুক্তিগত গবেষণা দরকার, তাই পাওয়া গেছে জিটিজেডের কাছ থেকে। এখন সূর্যবাতির ব্যবসায় মডেল তৈরি করছেন সাজিদেরা। দেখতে অনেকটা চার্জার বাতির মতো এমন সৌর লন্ঠনও তৈরি করেছে চেঞ্জ। আর বানিয়েছে ছোট আকারের সৌরবিদ্যুচ্চালিত সেচযন্ত্র (পাম্প)। তরুণদের যুক্ত করে নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির জন্য চেঞ্জ যে ‘ইনোভেশন হাব’ গঠন করেছে তার অর্থায়ন করেছে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস।

বাবা ইকবাল ইসরাইল, মা শারমিন রেজা আর ছোট বোন সারিকা ইকবাল—এই হচ্ছে সাজিদের পরিবার। একসময় ফেনসিং খেলোয়াড় ছিলেন সাজিদ। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন চার বছর।

২৭ বছর বয়সী এই তরুণ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় স্নাতক এবং পরিবেশবিজ্ঞান ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। পড়াশোনার সময়ই (২০১২) বোতল বাতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। সেই থেকে চেঞ্জেরও শুরু বটে। বোতলবাতির প্রকল্পটি এখন আর নেই। কারণ হিসেবে জানালেন, সেটা ছিল পরীক্ষামূলক প্রকল্প। ‘একটা প্রযুক্তি যখন দেওয়া হয়, পরে তার মেরামতের ব্যবস্থাও রাখতে হয়। চার হাজার বোতলবাতির বেলায় সেটা আমরা দিতে পারিনি, অনেক চেষ্টা করেও।’

সাজিদ ইকবাল যুক্তরাজ্যের কুইনস লিডার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন গত বছর। এখন পেলেন ফোর্বস-এর স্বীকৃতি। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ-শক্তি নিয়ে যে কাজটা করছেন, তাকে তিনি সামাজিক ব্যবসা হিসেবেই দেখছেন। ‘প্রকল্পগুলো তহবিলের ওপর নির্ভরশীল থাকলে হবে না। টেকসই মডেল থাকতে হবে। শিল্পকারখানায় যে বাতি আমরা দেব, তা থেকে টাকা পাব। সে টাকায় গবেষণা চলবে। নবায়নযোগ্য প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যেতে হয়।’

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) ক্যাডেটদের নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করাচ্ছেন সাজিদ ইকবাল। বললেন, বিএনসিসির ৪০ হাজার নিবন্ধিত ক্যাডেট রয়েছেন। আরও বেশি সাধারণ ক্যাডেট—তাঁদের কাজে লাগানো গেলে এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করা যাবে।

প্রাকৃতিক আলোকে বৈদ্যুতিক বাতির বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের যে উদ্যোগ, যে স্বপ্ন সাজিদ ইকবাল দেখছেন, তাতে যুক্ত করছেন আরও অনেক তরুণকে। এই বাতির আলোয় আলোকিত করতে চান আগামী দিনের সমাজ।